আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক সঠিক পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে গ্রহণ করার নাম হালাল রুজি। যা একজন মানুষ ঈমানদার হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত। হালাল উপার্জন ছাড়া একজন মুসলিমের জীবন সম্পুর্ণ ব্যর্থ। পবিত্র কোরানুল কারীমে বর্ণিত মুমিনের গুণাবলির মধ্যে অন্যতম হল হালাল উপার্জন। যা শারীরিক ও আর্থিক সকল ধরণের ইবাদাত কবুল হওয়ার জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মানব জাতি! তোমরা পৃথিবী থেকে হালাল ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (বাক্বারাহ ২/১৬৮)।
সাধারণভাবে ইসলামি আইন দ্বারা অনুমোদিত সবকিছুই হালাল। আর হালালের বিপরীত হল হারাম। যা ইসলামী আইন অনুযায়ী স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।
হাদিসের ভাষায়, 'আল্লাহ তাঁর কিতাবে যেসব জিনিস হালাল করেছেন তা হালাল এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে যেসব জিনিস হারাম করেছেন তা হারাম। আর যেসব জিনিস সম্পর্কে তিনি নীরব থেকেছেন তা তিনি ক্ষমা করেছেন’।(তিরমিযী হা/১৭২৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৬৭; মিশকাত হা/৪২২৮, সনদ হাসান।)
অর্থাৎ হালাল রুজি হল যা শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত এবং নিষেধাজ্ঞার বন্ধন থেকে মুক্ত।
কোন কিছু হালাল হারাম হওয়ার জন্য ইসলামী শরীয়ত কিছু মুলনীতি অনুসরণ করে:
*ইসলাম কর্তৃক আরোপিত যা হালাল করা হয়েছে তা হালাল আর যা হারাম করা হয়েছে তা হারাম । আল কুরআনে এসেছে, রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্ৰহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক (২) এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ শাস্তি দানে কঠোর। (সুরা হাশর,আয়াত-০৭)
*সব ধরনের ক্ষতিকর বস্তুই হারাম ।
*হারাম কাজ সংঘটিত হওয়ার সকল উপকরণই হারাম।
*হারাম কাজ করার জন্য কোশল অবলম্বন করা হারাম।
*যে বস্তুতে অন্যের অধিকার আছে তা হারাম। হাদীস শরীফে এসেছে -একজন মুসলিমের অপর মুসলিমের রক্ত, সম্পদ, সম্মান (অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা) হারাম করা হয়েছে। (সহিহ মুসলিম।)
কুরতুবী (রহঃ) সুরা বাকারার ১৬৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের নিম্নোক্ত অভিমত তুলে ধরেছেন-
(১) সাহল বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘নাজাত তিনটি জিনিসে। তাহ’ল ১. হালাল খাবার গ্রহণ করা, ২. ফরয সমূহ আদায় করা এবং ৩. নবী করীম (সঃ)-এর অনুসরণ করা।
(২) সাঈদ বিন ইয়াযীদ বলেন,‘পাঁচটি গুণে ইলমের পূর্ণতা রয়েছে। আর তা হ’ল আল্লাহকে চেনা, হক বুঝা, আল্লাহর জন্য ইখলাছপূর্ণ আমল করা, সুন্নাহ মোতাবেক আমল ও হালাল খাদ্য গ্রহণ করা। আর এর একটি নষ্ট হ’লে আমল কবুল হবে না’। তাফসীরে কুরতুবী, ২/২০৮, সূরা বাক্বারাহ ১৬৮নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
হালাল রুজি হালাল হচ্ছে তো ?
যারা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না তাদের ব্যপারে নবী করিম সতর্ক করেছেন।
‘‘মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোন উৎস থেকে সম্পদ আহরন করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করবে না।’’ [. ইমাম বুখারী, আস-সাহীহ, হাদীস নং ২০৫৯।
উপার্জনের আংগিনায় নিজের আয় হালাল রাখা এবং রাখতে পারা খুবই সুক্ষ এবং ঈমানী ব্যাপার। যেমন-
# চাকুরি, ব্যবসা, চাষাবাদ যে পেশারই হোক না কেন নির্দিষ্ট আয়ের বাইরে বাড়তি আয়, বাড়তি লাভ করার ইচ্ছা মোটামুটি সকলেরই থাকে। সেক্ষেত্রে ইসলামে কোন বাধা বা নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে দেখা যায়, মূল আয় হালালভাবে উপার্জন করলেও বাড়তি উপার্জন হালাল হোক বা হারাম সে ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপ বা অনুশোচনা থাকে না।
# আবার দেখা যায়, হালাল পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদ এবং ঘুষ নামক হারাম লেনদেনের সাথে জড়িত।
# বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিজের প্রতি আরোপিত দায়িত্ব অবগত থাকা সত্ত্বেও তা পালন করার ক্ষেত্রে অবহেলা, অনিয়ম, ঠিকভাবে পালন না
করে অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে মজুরি গ্রহণ করা।
নিজের অধিনস্ত কর্মচারীদের প্রতি জুলুম করা, নিজের দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। নিজেকে মহান জাহির করার জন্য অন্যের ব্যাপারে সত্য মিথ্যা বলে বেড়ানো, সহকর্মীদের সাথে লোভ হিংসা এসব এত পরিমাণে দেখা যায়, যা সত্যিই দুঃখজনক।
অফিস বা প্রতিষ্ঠানের জিনিস নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা। অর্থ সংক্রান্ত লেনদেনের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা, অসংগতি যেন স্বাভাবিক।
শ্রমিকের প্রাপ্য (ইচ্ছাকৃত) সঠিক সময়ে না দেয়া, ওজনে কম দেয়া, পণ্যের দোষ ত্রুটি লুকানো, বিক্রেতা ক্রেতাকে ঠকানো, ক্রেতা বিক্রেতাকে ঠকানো ইত্যাদি। এসব পেশা হালাল হলেও হারামের অংশ মিশ্রিত হওয়াতে হালাল হিসেবে গণ্য হবে না।
যেমন মদ হারাম, তা হালাল অর্থ দিয়ে কখনো হালাল হবে না । ঠিক তেমনিভাবে গরুর মাংস হালাল ভাবে জবেহ করে যদি হারাম টাকায় কেনা হয় তা কখনো হালাল হবে না। শুধু খাবার হালাল কিনা সেটা জানার পাশাপাশি যে পন্থায় খাবার আসছে সেটা হালাল কিনা সেটা লক্ষ্য রাখাও সমান জরুরি।
উপার্জন হালাল রাখার শরয়ী সমাধানঃ
মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতাঃ
প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নেয়ামতের শুকর করা। যা তিনি দিয়েছেন, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার পাশাপাশি তার অশেষ রহমত এবং নেয়ামতের কামনা করা।
আল কুরআনের বাণী –তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞতা কর, তবে জেনে রেখ আমার শাস্তি অতি কঠিন। সুরা ইব্রাহিমঃ০৭
আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলঃ
আল্লাহর প্রতি ভরসা করা, ভালো মন্দ সুখ দুঃখ সব আল্লাহর ফয়সালার উপর সঁপে দেয়া, তার সিদ্ধান্তে নিজের কল্যাণ খুজে নেয়া ,নিজের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করা বাকিটুকু মহান রবের উপর ছেড়ে দেয়া শরীয়তের হুকুম এবং মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আল কুরআনে এসেছে, ‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাকো, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো।’’ (মায়েদা : ২৩)
আল কুরআনে আরো আছে, "যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট।’’ (সূরা তালাক . ৩)
প্রাপ্ত নেয়ামতে তুষ্ট থাকাঃ
এই মহাবিশ্ব মহান রবের নেয়ামত, রিজিক, অনুগ্রহ, করুণা, দয়া, ভালোবাসায় ভরপুর। কিন্তু বান্দা অনেক সময় তার চেয়ে উপরে যারা আছে তাদের দেখে কষ্ট পায়, নেয়ামতের অস্বীকার করে, লোভ হিংসা বিদ্বেষে লিপ্ত হয়ে ফলশ্রুতিতে বিপরীত ফলাফল দেখতে পায়। হাদিস শরীফে এসেছে- ‘তোমাদের চাইতে নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির দিকে তাকাও এবং তোমাদের চাইতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্নদের দিকে তাকিও না। আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহকে তুচ্ছ মনে না করার জন্যে এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা’। (তিরমিযী হা/২৫১৩; ইবনু মাজাহ হা/৪১৪২, সনদ ছহীহ।)
হালাল উপার্জন তখনি হালাল হবে যখন বান্দা লোভ, বেইনসাফি, অন্যের প্রতি জুলুম অর্থাৎ সকল অনিষ্ট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে। হালাল হারামের সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত থাকুক সবাই। গড়ে উঠুক সুন্দর পৃথিবী। ভালো থাকুক সব মানুষগুলো, সুন্দরভাবে অর্জিত হোক সকলের উপার্জন।
লেখক:
প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ।
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় , চট্রগ্রাম।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan